Wednesday 11 May 2016

এতো শহীদ আর বীরঙ্গনার দেশে চলচিত্রের মৌলিক কাহিনীর সংকট!

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে মার্চের ১৬/১৭ তারিখ যুক্তরাষ্ট্র জাপানের কোবে কুখ্যাত 'বোম্বিং অব কোব' নামের বোমা হামলা চালালে সাধারণ জনগণের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষের বাড়ী পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় আর দশ লাখ মানুষের বাড়ী আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এমনি একটি ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের ছেলে ছিলো একিইউকি নোসাকা। ওই বোমা হামলায় তার পিতা মারা যায়, দুই বোন মারা যায় অসুস্থতায় আর অপুষ্টিতে। চারপাশে পুঁড়ে যাওয়া ঘরবাড়ী, চোখের সামনে অপুষ্টিতে মরে যাওয়া মানুষগুলোর কথা ভুলে যায়নি সে। পরবর্তীতে সেই দুঃসহ বেদনার দিনগুলোর ছায়া অবলম্বন করে রচনা করে ছোটগল্প 'গ্রেভ অব দ্যা ফায়ারফ্লাইস্' বা 'জোনাকিদের কবর'। এই লেখক যুদ্ধ আর যুদ্ধশিশুদের নিয়ে লেখার জন্য বেশ বিখ্যাত ছিলেন। 'গ্রেভ অব দ্যা ফায়ারফ্লাইস্' নামের ছোটগল্পটাই পরে অ্যানিমেটেড মুভী (অ্যানিম) আকারে প্রকাশ হলে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সাড়া পায় আর এই গল্প নিয়েই মানুষজনের (বিশেষ করে অ্যানিম প্রিয় শিশু-কিশোরদের) এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জানার আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।

'Saving Private Ryan','Band of Brothers','The Pacific','The Thin Red Line','The Big Red One','The Bridge'-সহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে নির্মিত মুভী বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন তুলে। এগুলো শুধুই মুভী বললে ভুল হবে, নতুন প্রজন্মের কাছে যুদ্ধের ব্যাপক ভয়াবহতা তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ভারতের স্বাধীনতা নিয়ে, দেশভাগ নিয়ে প্রচুর বই আছে। সবগুলো উল্লেখ না করলেও শুধু ওপার বাংলার নামী-দামী লেখকদের অনেক গল্প-উপন্যাসই বয়ে বেড়ায় দেশভাগের কষ্টের তীব্র হাহাকার। 'মেঘে ঢাকা তারা', 'শঙ্খচিল' আর হালের 'রাজকাহিনী'-র মতো চলচিত্রগুলো মূল পটভূমিই তো ১৯৪৭-এর দেশভাগ। মজার ব্যাপার হলো ইন্ডিয়ার কিছু মুভীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে উপস্থাপন করা হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের অংশ হিসেবে!

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচুর বই রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধারা লিখে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে রেফারেন্স বইয়েরও অভাব নেই। এক জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি' বইয়েই ঢাকা শহরে যুদ্ধের ভয়াবহতা আর পাকি আর্মি শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতনের বর্ণনা আছে। যুদ্ধের ময়দানে বসে লেখা আনোয়ার পাশার উপন্যাস 'রাইফেল, রোটি, আওরাত' আছে। নীলিমা ইব্রাহিমের 'আমি বীরঙ্গনা বলছি', মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার 'জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা'-তে আছে যুদ্ধে তাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস, সম্মুখ সমরযুদ্ধের বর্ণনা নিয়ে কম করে হলেও হাজার খানেকের উপর বই আছে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় এসেছে ওইসময়কার পাকিস্থানপন্থী রাজাকার, আল বদর, আল শামসদের কর্মকান্ডের বর্ণনা। আমরা এ প্রজন্মের অনেকের মুক্তিযুদ্ধের গল্প প্রথম পড়া হয় হুমায়ূন আহমেদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল আর আনিসুল হকদের বই দিয়ে। মুনতাসির মামুন আর অমি রহমান পিয়ালরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একদম নগদে বাঁচিয়ে রাখার কাজ করছে এখনো। এক কথায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প আর ইতিহাস বইয়ের ভান্ডার অনেক সমৃদ্ধ।

আমাদের দেশের চলচিত্র নির্মাতারা নাকি ভালো গল্প পায় না। ভালো গল্পের অভাবে নাদুস-নুদুস একঘেয়ে প্রেমের বস্তাপঁচা মুভী বানাতে নাকি বাধ্য হয়। তার উপর আছে ইন্ডিয়ান মুভীর গল্প চুরি করে বাংলা ছবি বানানোর হিড়িক। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে 'ওরা এগারো জন', 'আমার বন্ধু রাশেদ' বা 'গেরিলা'-র মতো হাতে গোণা কয়েকটা চলচিত্র ছাড়া তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ছবি তৈরী হয়নি। ওপার বাংলায় যেখানে ইতিহাস আর উপন্যাস অবলম্বনে বছরে কম করে হলেও নয়-দশটা ভালো মুভী তৈরী হয় সেখানে আমাদের চলচিত্রকাররা গল্প খুঁজে পায় না।

জাতি হিসেবে মোটা দাগে ইতিহাসের বইয়ে লিখে রাখার মতো বৃটিশ শাসন বিরোধী আন্দোলন, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅদ্ভূত্থান, ১৯৭১'এর মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ে এরশাদ বিরোধী তীব্র ছাত্র-আন্দোলন রয়েছে। ওসব আন্দোলনে ঝরে গেছে অনেক প্রাণ, নিঃস্ব হয়েছে অনেক পরিবার। ওসব পরিবার নিয়ে কি ভালো গল্প হয় না? মন ছুঁয়ে যাওয়া কাহিনী কি নেই?!

আমার এক পিচ্ছি কাজিন প্রাইমারী লেভেলে টার্ম পরীক্ষা দিচ্ছিলো। পাশের সিটে বসা এক ছেলে ওর খাতায় যা ছিলো সব হুবুহু লিখে দিয়েছে। পরীক্ষার কপি পরে যখন শিক্ষিকা ডিসস্ট্রিবিউট করছিলো তখন দেখে আমার কাজিনের নামের কপি দুইটা! যে ছেলে কপি করছিলো সে খাতায় নিজের নাম-রোলও কপি করে দিয়েছে।

আমাদের মিডিয়ায় ইন্ডিয়ার সবকিছুই অন্ধের মতো কপি করার প্রবণতা আছে। সিরিয়াল, মিউজিক ভিডিও, টিভিসি, মুভী সবই। নিজস্বতার জায়গাটা হারিয়ে ফেলেছে। ইন্ডিয়ান মিডিয়ায় যেভাবে বাংলাদেশের অতীত ইতিহাসের কৃতিত্বতে ভাগ বসানোর প্রবণতা আছে, তাতে না জানি আমাদের মিডিয়াও পরীক্ষার খাতায় অন্যের নাম-রোলসহ কপি করার মতো নিজেদের কৃতিত্ব ইন্ডিয়ানদের দিয়ে বসে!

আর বইবিমুখ নয়া প্রজন্মের জন্য কি 'গ্রেভ অব দ্যা ফায়ারফ্লাইস্' এর মতো আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা গল্পগুলো থেকে মুভী বানানো যায় না?
তাতে অন্তত কোন পাকিস্থানপন্থী রাজাকারগুলোর ছড়ানো মিথ্যের শিকড় আস্তে আস্তে নয়াপ্রজন্মকে গ্রাস করা থেকে দূরে রাখতে পারবে। শিশু-কিশোররাও মুভী-অ্যানিমেশন দেখে আগ্রহী হবে দেশের ইতিহাস জানতে।

Friday 6 May 2016

অাধুনিক শ্রেণীবৈষম্য


চৌধুরী এর 'চৌ' এর অর্থ চার আর 'ধুরী' মানে ধরে রাখা/বহন করা। মূলত চৌধুরী তারাই যারা হিন্দু ধর্মের চার বর্ণেই (বাক্ষ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র) একসাথে ধারণ করে। মুঘল আমলে মুসলিম শাসকরা নিজেদের সবধরণের জনগণের প্রতিনিধি প্রমাণে এই টাইটেল গ্রহণ করে। তালুকদার তাদের বলা হতো যারা মুঘল আর বৃটিশ আমলে জমির মালিক ছিলো। মজুমদার তারা যারা রাজস্বের হিসেব রাখতো। ভূঁইয়ারা ছিলো সুলতানি আমলে এই অঞ্চলের জমির মালিক কাম শাসক। শেখ টাইটেল যাদের ছিলো মূলত তাদের পূর্বসূরীরা এই অঞ্চলে ইসলামের প্রচারের জন্য আরব থেকে এসেছিলো।

বৃটিশরা যখন সিরাজোদ্দৌলাকে মীর জাফরদের বেঈমানীর কারণে সহজে পরাজিত করে এই অঞ্চলে ক্ষমতা দখল করে শোষণ শুরু করে তখন থেকেই এই অঞ্চলে 'মীর জাফর' নামটাকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়, পারতপক্ষে কেউ জেনে শুনে নিজের সন্তানের নাম মীর জাফর রাখার সাহস করে না। আমাদের বেঈমানদের গালাগালির সুবিধার্থে দুটো শব্দ খুব বেশি ব্যবহার করি। একটা এই 'মীরজাফর' আর আরেকটা 'রাজাকার'। মীরজাফরের তুলনায় রাজাকার গালিটায় তীব্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই ঘটায়। এক অর্থে চিন্তা করলে মীরজাফর একটা রাজাকার ছিলো। তবে রাজাকারকূলের শিরোমনি গোলাম আজমের জনপ্রিয়তা খুব যে খারাপ ছিলো বা আছে তার জন্য তার নামে আরো শ' কিংবা হাজার খানেক বাংলাদেশী থাকাটা বিস্ময়ের কিছু নয়।

সত্তরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান বা এই বাংলায় জামাতের একটা আসন বাদে কোন তীব্র পাকিস্তানপন্থী কোন দল একটা আসনও না জিতলেও বিহারী আর কিছু সাচ্চা পাক-পাকিস্তানিদের সহায়তায় পাকিস্তানপন্থীদের ভোটের হার একদমই কম ছিলো না। সে হিসেবে হাজারখানেক গোলাম আজম এদেশে থাকাটাই স্বাভাবিক।

মূল কথায় আসি, এই যে চৌধুরী, তালুকদার, ভূঁইয়া, শেখ কিংবা কাজী বংশ নিয়ে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এতো মাতামাতি হয় কিন্তু ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখা যায় এই টাইটেলের লোকগুলোই তৎকালীন বৃটিশ শাসকদের প্রধান চামচা ছিলো। এরা নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখার জন্য বৃটিশ শোষকদের চরণ ধুঁয়ে নিজ দেশের জনগণের উপর প্রচন্ড রকমের অত্যাচার করতো। খাজনা নেওয়া নিয়ে কঠোরতার চূড়ান্তরূপ দেখাতেও তাদের গা কাঁপতো না। ওইসময়কার ইতিহাস আর গল্প-উপন্যাসে দেশী শাসকদের সহায়তা বৃটিশদের শোষণের চিত্র খুব স্পষ্টভাবেই পাওয়া যায়। এজন্য বলা যায় এরাও আসলে একপ্রকারের রাজকার ছিলো। কিন্তু ভাগ্য এই সুপ্রসন্ন যে বৃটিশরা চলে যাওয়ার পর এমন শোষকদের কেউ বিচারের দাবি তুলেনি। স্বাধীন দুই রাষ্ট্রে 'জয় হিন্দ' আর 'পাকসার জমিন সাদবাদ' করে এরাই কিংবা এদের উত্তরসূরীরাই বিভিন্ন অঞ্চলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ ছিলো।

একটা মজার ব্যাপার হলো দেশভাগের নামে যে দুটো আলাদা রাষ্ট্র হলো, সেই রাষ্ট্রগুলোর পূর্ববর্তী কোন একক রাষ্ট্র ছিলো? ছিলো না। বৃটিশ সাম্রাজ্যের আগে বিভিন্ন অঞ্চলে আলাদা শাসন ছিলো। আর ভারত ছিলো মহাভারতে উল্লেখিত 'আসমুদ্র হীমাচল' মানে হীমাচল থেকে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত একটা সাম্রাজ্য যার আসলেই ঐতিহাসিক কোন শক্ত কোন ভীত্তি নেই। যাই হোক, ভারত রাষ্ট্র হয়ে তাদের সংবিধান লিখতে দিলো অচ্ছুত বর্ণের বা শ্রেণীহীন দলিত হিন্দুদের প্রতিনিধি বি আর আম্বেদকারকে (পরবর্তীদে বুদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নেয়), আর প্রমাণ করলো এই ভারত সকল শ্রেণীর আর মানুষের জন্য। পাক জমির পাকিস্তান তো ততদিনে একটা সংবিধান বানাতেও হিমশিম খেতে খেতে শেষ। মুখে দুই রাষ্ট্রের এক কথা, সব শ্রেণীর মানুষের সমান অধিকার। কাজে কর্মে জনগণই সেটা বিশ্বাস করতো না, বরং যে যেভাবে পেরেছে নিজেদের নামের পাশে চৌধুরী, তালুকদার, কাজী, ভূঁইয়া প্রভৃতি টাইটেল লাগিয়ে শ্রেণীসম্পন্ন মানুষে পরিণত করেছে। দেশভাগের পর এপারের অনেক মানুষ ওপারে গেলো, ওপারের অনেকেই এপারে এলো। বিহার থেকে বিহারী এলো। তারপরও মনেপ্রাণে সবাই একই জাতিসত্তা গ্রহণ করতে পারলো না। পাক সার জমিন বাদ হয়ে একপ্রান্তে লাল সবুজের বাংলাদেশের জন্ম হলো, আরেকপ্রান্ত তার সেই প্রতিপত্তি হারালেও পাকিস্তান নাম নিয়েই বেঁচে আছে। তবে এখনো মানুষগুলো বদলায়নি। এখনো মানুষজন তাদের জাতিসত্তাগুলো সত্যিকার অর্থে ধারণ করতে পারেনি। এখনো একটা তামিল পরিবার একটা বাঙ্গালি কিংবা একটা মারাঠী পরিবারের সাথে নতুন সম্পর্কে যেতে দু'চারবার ভাবে। ভারতীয় সত্তা ধারণ করতে না পারায় তাদের 'কমন' কালচার বলতে বলিউডই আছে। কিন্তু সবাই নিজ নিজ সংস্কৃতি আর চিন্তা চেতনায় পড়ে আছে। তাইতো 'টু স্টেটস্' এর মতো মুভী কিংবা বই লিখে মনেপ্রাণে ভারতীয় হয়ে ওঠার জন্য লেখককে উৎসাহ দিতে হয়।

 বাঙ্গালী বাংলাদেশী একক জাতিসত্তার এই বাংলায় তো অবস্থা আরো করুণ। এক পরিবারের সাথে আরেক পরিবারের সম্পর্ক করার আগে যা যা দেখতে হয়ঃ
১. ধর্ম এক কি না।
২. এলাকা এক কি না। (নোয়াখাইল্লা-বরিশাইল্লা বাছবিচার)
৩. সংস্কৃতিমনা উদার নাকি রক্ষণশীল মুসলিম/ধার্মিক কি না (হালের লোক দেখানো ট্রেন্ডী হাজী মুসলিম পরিবার চায় আরেকটা ধার্মিক পরিবার আর উদারমনা দাবিদাররা চায় তাদের মতো)
৪. পরিবারের টাইটেল উঁচু কি না (বংশ মর্যাদার লেভেল টাইটেলে বিদ্যমান অনেকাংশেই)
৫. পূর্বপুরুষরা এই বাংলার নাকি ওই বাংলা বা ভারত থেকে আগত ছিলো কি না (মানে অনেকের মতে দাদা-বাবারা এই বাংলায় জন্মসূত্রে বসবাসকারী না হলে সহীহ বাংলাদেশী বলা যাবে না! :3 )
৬. শিক্ষা (সার্টিফিকেট দেখানোর মতো হলেই হবে)
৭. ৮. ৯. .... ৯৯. (অর্থ সংশ্লিষ্টবিষয়াদীসহ বিস্তারিত গবেষণা।)

মূলত এই যে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের নিয়ে গর্ব করে অ্যাডভান্টেজটা নেই, তাদের কর্মকান্ড কি আসলেই গর্ব করার মতো কিছু ছিলো কি না তা অনেক বেশি প্রশ্নসাপেক্ষ, তবে মনমানসিকতায় আমরা এখনো শ্রেণীবৈষম্য পুষে বেড়াই। একটা রাষ্ট্র যেখানে সবার অধিকার সমান হওয়ার কথা, সবার সুযোগ সুবিধা সমান হওয়ার কথা.. সেখানে রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই দখল দখল করে নিজেই খব সাবাড় করে শ্রেণীযুক্ত হয়ে লুটপাট করে যে যেভাবে পেরেছে উঁচুশ্রেণীর মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগীতায় নেমেছে। যেখানে সবাই সবার সহযোগীতার মাধ্যমে সমান হওয়ার কথা সেখানে সেই আমরা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে ব্যর্থ করে দিয়ে প্রশাসনকে গালি দেই। মাঝে মাঝে মনে হয় এই বৃটিশ তাড়ানো থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যারা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন দিয়েছে তারা অযথাই জীবনগুলো সেক্রিফাইস করেছে। যাদের সেক্রিফাইসের ফলে লুটেরা-রা আরও বেশি লুট করার সুযোগ পেয়ে সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে, তাদের জন্য এসব সেক্রিফাইসের কোন দরকার ছিলো না। একশ-দুইশ বছর আগে যারা ভাবতো বৃটিশরা চলে গেলে আমরা সবাই শান্তিতে থাকবো তারা আসলেই বোকা ছিলো, যারা পঞ্চাশ বছর আগে ভাবতো পাকিরা চলে গেলে আমরা শান্তিতে থাকবো তারাও বোকা ছিলো। আসলে আমরা মনের কলুষতা দূর না করে সবাই এক একজন চৌধুরী, তালুকদার, ভূইয়া প্রভৃতি হয়ে বাঁচতে চাই। এখানেই মূল সমস্যা। আমরা কেউ বাংলাদেশী হতে চাই না। মনে প্রাণে একদমই হতে চাই না।

রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা যদি ব্যর্থ হয় তবে ব্যর্থতার জন্য আমাদের মানসিকতাই দায়ী।

Thursday 5 May 2016

রিভিউঃ আধো ঘুমে ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে

কিউবার মতো আমেরিকার নাকের ডগায় থাকা একটা দেশ স্পেন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করতে সাহায্য পায় আমেরিকার। তারপর? বিশ্বরাজনীতির নিয়ন্ত্রক পুঁজিবাদী আমেরিকা দখল করে কিউবার অর্থনীতি। পুতুল সরকার বসিয়ে কিউবার সম্পদ অাহরণ বেশ ভালোভাবেই করছিলো। এক স্পেনিশ বাবা আর কিউবান মায়ের ঘরে জন্ম হয় ক্যাস্ট্রোর.. ফিদেল ক্যাস্ট্রো। শৈশবেই প্রথা অনুযায়ী পড়ালেখার উদ্দেশ্যে বাবা-মায়ের থেকে দূরে পাঠানো, তারপর একসময় বোর্ডিং স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে রাজনীতিতে পা। পুঁজিবাদে বড়ই অনাস্থা। নিজের ভাই রাউল ক্যাস্ট্রোকে সাথে নিয়ে গেরিলা দল বানিয়ে সামরিক ঘাঁটিতে হামলা, সামরিক বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে বন্দী জীবন, মৃত্যুর খুব কাছে থেকে ফিরে আসা, জীবন বাঁচাতে মেক্সিকো গমন, চে গুয়েভারার সান্নিধ্য, একসাথে কিউবায় আক্রমণ, চূড়ান্ত বিজয়, আমেরিকার সাথে স্বল্পশক্তি নিয়েও যুদ্ধে প্রতিরোধ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার স্বত্তেও মাথা উঁচু করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সোভিয়েত পতনের পরও সমাজতন্ত্র নিয়ে সফলভাবে দেশ পরিচালনা আর বিশ্বমিডিয়ায় ক্রমাগত উদ্দেশ্যমূলকভাবে খলনায়ক আর একনায়ক হিসেবে উপস্থাপনের পরও কিভাবে দেশের জনগণের ভালবাসায় এখনো সিক্ত হন সে সব নিয়ে ফিদেল ক্যাস্ট্রে গল্প করেছেন বাংলাদেশী এক তরুণের সাথে।


কাল্পনিক সাক্ষাতকার হলেও লেখক শাহাদুজ্জামান বেশ চমৎকারভাবে ফিদেল ক্যাস্ট্রো, ক্যাস্ট্রোর আদর্শকে এবং জীবনীকে সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন। এক কথায় বইটিকে বাংলা ভাষায় লেখা অন্যতম সেরা ডকুফিকশনের স্বীকৃতি দিতে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে না!

A life lesson

প্রথমে তিনজন মানুষ সম্পর্কে সংক্ষেপে বলে নেই। NSU লাইফে ৯০% কোর্সেই আমার অ্যাসাইনম্যান্ট বা প্রজেক্টের গ্রুপে নাজিয়া গ্রুপ পার্টনার ছিলো। প্রায় প্রতি সেমিস্টারে বেশির ভাগ কোর্সই মিলিয়ে নেই যাতে অ্যাসাইমেন্ট বা প্রজেক্টের লেখার কাজগুলো ভাগ করে নেয়া যায়। ল্যাব রিপোর্ট লেখার কাজ সবসময়ই আমি এড়িয়ে যেতাম বিরক্তিকর মনে হতো দেখে আর আমার এই কাজটা নাজিয়া করে দিতো।

হাসিবুলের সাথে পরিচয়ের পর হাসিবুলও প্রায় সব কোর্সেই প্রজেক্ট বা গ্রুপ পার্টনার ছিলো। কাজের ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য পরায়ন এবং সময়ের কাজ সময়ে করে আর আলসেমি করে না। গ্রুপের কেউ কোন কাজ না করলে তা করিয়ে নেয়ার ক্ষমতাও চমৎকার।

সাবেক ঘুমকুমার নাঈম রিদওয়ান আবীর হলো একজন অমায়িক মানুষ। যদিও আমার প্রতিবেশী তাও সে মাঝে মাঝে নিখোঁজ হয়ে যায়, কিন্তু কাজের অ্যাকুরেসি অনেক ভালো। মানুষকে যে কোন ব্যাপারে সারল্যের সাথে নিঃশর্ত সাহায্য করতে করতে তাকে আমার বন্ধুমহলের সবচে 'ইউজড্ পারসন' হতে দেখেছি। আবীর আর নাজিয়া হলো আমার প্রথম সেমিস্টার থেকেই সবচে কাছের ফ্রেন্ড, যাদের সাথে সবসময় এটা-ওটা নিয়ে গ্যাঞ্জাম লেগেই থাকে।

যাই হোক, মূল ঘটনায় আসি। ফাজি লজিকে যখন প্রথম ছয়জনের গ্রুপ ফর্ম হচ্ছিলো তখন আমি, হাসিব আর নাজিয়া একসাথে গ্রুপে থাকার কথা হয়। বাকী তিনজন আগেও পেপার পাবলিস করেছে, তাই তাদের সাথে নিতে চাওয়ায় আমরাও রাজী হয়ে যাই। কোর্সের শুরুতেই এভাবেই কথা ফাইনাল হয়। কোর্স রি-অ্যাডভাইজের পর আরো কয়েকজন কোর্সে অ্যাড হয়, যার মধ্যে আবীরও ছিলো। যাই হোক, যাদের সাথে করার কথা তাদের তিনজনের ক্লোজ ফ্রেন্ড আর আগের পেপারের গ্রুপমেট কোর্সটা রিঅ্যাডভাইজ করে নেওয়ায় আমরা ওদের অনুরোধ করার প্ল্যান করি যাতে তাদের পুরোনো পার্টনারকে নেয়, আমরা আবীরকে নিয়ে আরেকটা গ্রুপ করবো। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই পরিচিত একজন শ্রদ্ধেয় বড় ভাই (যিনি এর আগেও অনেক কোর্স আমাদের সাথে করেছেন) আমার কাছে এসে বললেন, 'জিটু তুমি নাজিয়াকে বা হাসিবকে বাদ দিয়ে ওই গ্রুপে থেকে যাও। বিশেষ করে বলছি, হাসিবকে বাদ দিলে ভালো হয়। ও কি পারে? কিচ্ছু তো করবে না!'

উল্লেখিত বিশিষ্ট বড় ভাইয়ের কথায় আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমাদের সম্পর্কে অবজ্ঞাসূচক ভাল রকমের কথাবার্তা বললেন। যাই হোক, কথা শেষ হওয়ার পর এ ব্যাপারে কিছু না জানিয়ে নিজেরাই গ্রুপ ফর্ম করলাম। কথা দিয়ে তো আর কথা ভঙ্গ করা ঠিক না, আর আমি এদের কথা দিয়ে অন্যগ্রুপেও যেতে পারি না। গ্রুপে ছিলাম আমি, হাসিব, নাজিয়া, আবীর আর সাথে সোনিয়া, ইভা। অবজ্ঞাটা খুব খারাপ লেগেছিলো, তাই বাকীদের বললাম কাজটা সিরিয়াসলি নিতে।

টপিক বেছে নেয়া থেকে শুরু করে প্রাথমিক সব কাজে হাসিব অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশি পরিশ্রম করেছে। কাজ করতে গিয়ে সবচে বেশি কষ্ট হয় ডাটা কালেকশনে। বারডেমে টানা পাঁচদিন গিয়ে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই অফিস ওই অফিস ঘুরে কোন লাভ হয়নি। শেষে বাধ্য হয়ে দুদিন সময় হাতে নিয়ে ফেনী গিয়ে ফেনী ডায়বেটিক হাসপাতাল থেকে ডাটা নিয়ে আসতে হয়েছে, সে কাজও প্রায় অসম্ভব ছিলো যদি না ডাক্তার বৈশাখী আপু আশাতিত ভাবে সাহায্য না করতো। সিস্টেম রেডী করতে গিয়ে যে অ্যালগরিদমে সাদা চোখে মনে হয়েছে কাজ হবে না তাও সেই কাজটা করে দেখেছি যাতে আমাদের কাজে কোন ছোটখাটো ভুল না থাকে। এজন্য হাসিব আর আবীর তো রীতিমত আঁটঘাঁট বেঁধে যুদ্ধে নেমে আমাকে পঁচাইছে। একদিন তো ডাটা ইনপুট করে চেক করার সময় কি এক ছোট্ট ভুলের জন্য স্টাডি হলে উত্তেজিত হয়ে টেবিল চাপড়ে হাসিব আর নাজিয়াকে কি কি যেন বলে মেজাজ খারাপ করে দিয়েছি। কাজের গুরুত্ব বুঝে আমার খারাপ ব্যবহারটা বড় করে দেখেনি তাই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আর আবীরকে তো অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে শেষ তিনদিন। সিস্টেমের ম্যাথমেটিক্যাল সব ক্যালকুলেশন বার বার করিয়েছি। একদিন সন্ধ্যা থেকে পরদিন দুপুর ১টা পর্যন্ত চেয়ার থেকে উঠতে দেইনি বরং আমি আর হাসিব ওকে ঝাঁড়ি মারতে মারতে নিজেরাই মাঝে দুঘন্টা করে ঘুমিয়ে নিয়েছি।

পুরো ইমপ্লিমেন্টেড সিস্টেম সম্পর্কে পেপার একবার লিখে সেটা পুরোটা বাদ দিয়ে আবার নতুন করে লিখতে হয়েছে। তবে এতকিছুর পরও সবচে ভালো লেগেছে যখন ডঃ রাশেদ স্যার বললো তোমাদের কাজ খুব ভাল হয়েছে। স্যারকে অনেক জ্বালিয়েছি, এটা ওটা নিয়ে উনাকে মেইল করে আর অফিসে গিয়ে হেল্প চেয়ে। স্যারকেও ধন্যবাদ দিয়েও শেষ করা যাবে না তার অবদানের জন্য। অনেক উৎসাহ দিয়েছেন। সবচে অবাক হয়েছি যখন পেপার স্যারকে ফাইনালী জমা দেয়ার দু'সাপ্তাহ না যেতেই স্প্রিংগার কনফারেন্সের জন্য পেপার অ্যাকসেপ্টেড হওয়ায়। আসলে কেমন মানের পেপার সেখানে অ্যাকসেপ্টেড হয় সেটাও জানতাম না, স্যার যদি গুরুত্বটা না বোঝাতো। শ্রদ্ধেয় রাশেদ স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

সত্যি বলতে ভালো মানের পেপার লেখার ইচ্ছে ছিলো শুধু অবজ্ঞার জবাব দেয়ার জন্য। এমন ছোটখাটো রিসার্চ পেপার আসলে অহরহ অনেকেরই পাবলিস হয়। আমরা যে কজন কাজ করেছি হয়তো কেউই অত আহমরি স্টুডেন্ট না, তাই নাক সিঁটকানো টাইপের কথা বলে, খোঁচা মারা কথা শুনেও কিছু বলতে পারিনি। শুধু ফোকাস ধরে রেখে সিরিয়াসলি নিজেদের কাজটুকু করার চেষ্টা করেছি আর তাতে বোধকরি সফল হয়েছি। বোধকরি, এভাবে সব কোর্সে যদি প্রথম থেকে সিরিয়াসলি পড়তাম তাহলে অসাধারণ রেজাল্ট নিয়ে বের হতে পারতাম।

মূলকথা বলি, আমরা ডায়বেটিস নির্ণয় নিয়ে Fuzzy Logic ব্যবহার করে একটা সিস্টেম ইমপ্লিমেন্ট করেছিলাম। টাইটেল Application of Fuzzy Logic for Generating Interpretable Pattern for Diabetes Disease in Bangladesh. চেক প্রজাতন্ত্রের টমাস বাটা ইউনিভার্সিটির উদ্দ্যোগে অনুষ্ঠিত 5th Computer Science On-line Conference 2016-তে আমাদের পেপারটা অ্যাকসেপ্টেড হয়। আজকে প্রেজেন্টেশন ছিলো। কিছুক্ষণ আগে Springer-এ আমাদের পেপারটা Artificial Intelligence Perspectives in Intelligent Systems সিরিজে পাবলিস হলো (লিংক প্রথম কমেন্টে)। যে কেউ চাইলে ২৯.৯৫ ইউ এস ডলারে কিনে নিতে পারেন!

এটা একটা সামান্য কাজ। এত বড় করে বলার কোন ইচ্ছে ছিলো না, আর আজকের পর কখনোই এই নিয়ে কথা বলবো না। তবে অবজ্ঞার একটা ছোট্ট জবাব দেয়ার ছিলো। ধন্যবাদ সেই মানুষকে যিনি আমাদের অবজ্ঞাসূচক কথাবার্তা বলে উৎসাহ দিয়েছেন। অনেক অনেক অনেক অনেক অনেক ধন্যবাদ তাকে। এমন লাইফ লেসন কয়জন দিতে পারে? !