১.
পৃথিবীর সবচে কষ্টের কাজগুলোর একটা হল এই সুদূর উত্তরা থেকে জ্যাম ঠেলে ঠেলে নীলক্ষেত যাওয়া, আবার আসা। আর এই কষ্টের কাজটা এড়াতে কিছু বাড়তি পয়সা গেলেও অনলাইনে বই অর্ডার করে কিনে নেই। কিন্তু ঈদের ছুটি থাকায় বই ডেলিভারী বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়েই নীলক্ষেত গিয়ে কিছু বই কিনে নিয়ে এলাম গত শুক্রবার। ভাবছিলাম সোমবার থেকে মোটামুটি ফ্রি থাকবো, শুক্রবারের মধ্যেই কিছু পড়া হয়ে যাবে আর অবসরটাও ভালই কাটবে। কিন্তু যেমন ভাবনা তেমনভাবে কি দুনিয়া চলে? কিছুই হয়নি। 'ক্রাচের কর্নেল' শুরু করেও বেশীদূর যেতে পারিনি এখনো। তবে বেশ ভালো লাগছে বইটা, যদিও উপন্যাসটার মূল পরিণতি মানে কর্ণেল তাহেরে ফাঁসি হয়ে যাবে শেষে জানি তবুও বইটা পড়ে অনেক তথ্যই জানতে পারছি। ওহ্.. এটা উপন্যাস কি না এ নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। রিভিউ জানতে গিয়েই ফেসবুকে বইপোকা গ্রুপে তুমুল বিতর্ক দেখলাম। বইয়ের লেখক সাহাদুজ্জামান আদৌ কোন উপন্যাসিক কিনা এ নিয়ে কিংবা সে মূলত ছোটগল্পকার - এসব নিয়ে বিতর্ক দেখে বইটা পড়ার উৎসাহ অনেকাংশেই বেড়ে গিয়েছিলো। তবে বইটা পড়া আমার কাছে সরাসরি না দেখা কোন বিখ্যাত ফুটবল ম্যাচের রিটেলিকাস্ট দেখছি, যার ফলাফল আগের থেকেই জানি।
২.
গত কিছুদিন ধরেই হুটহাট অনেকের সাথে পরিচয় হচ্ছে। ব্যাপারটা অনেকদিন ধরে হচ্ছিলো না। ভার্সিটিতে ভর্তির পর টানা দেড়-দুই বছর অনেক অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, অনেকের সাথে ভালো সম্পর্ক হয়েছে, অনেকের সাথে হাই-হ্যালো সম্পর্ক আর কারো কারো সাথে মনকষাকষিতে সম্পর্কই ভেঙ্গে গেছে - এমনটা সচরাচর হয় আরকি। রিভার সাথে পরিচয় কবে ঠিক মনে নেই, তবে আমাদের টিনএজের শেষের দিকে যখন মিগ৩৩ বা মিগ থার্টি থ্রি খুব জনপ্রিয় ছিলো মোবাইলে চ্যাটিং সফটওয়্যার হিসেবে তখন রঙ্গের মেলা নামে গ্রুপে। ফেসবুকেও ছিলো তখন থেকেই তবে লাইক-কমেন্টের বাইরে 'টুঁ' শব্দটাও চ্যাট হয়নি এমন আরকি। তো হঠাৎ করে কয়েকমাস আগে চ্যাট হলো, তাও খুব সম্ভবত শুক্রবার জুম্মার নামাজের টাইমে স্ট্যাটাস আপডেট করায় নামাজ পড়ি কিনা জিজ্ঞেস করেছিলো। তো যা হবার, কথায় কথায় এখন তুই তোকারি করে পচায় আরকি যে কিনা তিন-চার বছর ধরে আপনি-তুমির বাইরে সম্ভোধন করেনি। এ জন্যই বোধহয় জীবনের নাম 'গেবন' হয়ে গেছে!
৩.
কোন এক অদ্ভূত কারণে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপারে কিছু অবিশ্বাস্য মিথ চালু আছে। যেমন 'তারা কিছু পড়া লাগে না - এমনি এমনি ভাল গ্রেড পায়', 'টাকা দিয়ে পড়ে তাই এদের না পড়লেও রেজাল্ট ভালো হয়', 'এরা কিছু পারে না খামোখাই ভাব মারে', 'এরা ভার্সিটিতে গিয়ে আড্ডা মারে-এখানে ওখানে খেতে যায় আর সেলফি তোলে আপলোড মারে.. এরা কি ক্লাসে যায় নাকি কখনো? পড়ালেখা তো দূরের ব্যাপার।' ইত্যাদি ইত্যাদি। তো আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কষে থাপ্পর মারি এমন কথা বলা কিছু মানুষকে। এরা দু-একজনের লাইফস্টাইল দেখে সহজ সমীকরণ দিয়ে বখাইট্টা যুক্তি দেখান যে 'অমুক এটা করে, অতএব অমুকের ভার্সিটির সবাই এটাই করে'! বিশেষ করে থাপরাইতে ইচ্ছে করে যখন অনেক কষ্টে খেঁটে মেটে প্রোজেক্ট, আসাইনমেন্ট, পরীক্ষা সব ঠিকভাবে দেয়ার পরও এ-এ মাইনাস ছুটে যায় তখন। ঈদের ছুটিতে এ টাইপের কথাবার্তা শুনে গতকিছুদিন ধরেই মিস্টার মেজাজ আর তার 'বরফ স্টেট' থেকে উওপ্ত উনুনে জ্বলছে। যাই হোক, পলিটিক্যাল সাইন্স কোর্সের ইনস্ট্রাক্টর এক আমেরিকান ভদ্রমহিলা (এবং পলিটিশিয়ান)। সত্যি বলতে এ কোর্সের মতো মজার কোর্স আমি আমার ইহজগতে কম করছি। মঙ্গলবার ছিলো গ্রুপ প্রেজেন্টেশন। প্রেজেন্টেশন টপিক ছিলো সার্ক। আর আমাদের গ্রুপ রবিবার পর্যন্ত কোন কাজই করিনি। আমাদের গ্রুপের নাম 'মিশন ইম্পসিবল'। তো সোমবার মিড দিয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিকেলে উঠে শুরু করলাম কাজ, ইম্পসিবল মিশনকে পসিবল করে পরের দিনের জন্য প্রেজেন্টেশন স্লাইড রেডী করা। ত্রিশ মিনিটের প্রেজেন্টশন, অতএব পাঁচজনকে সর্বনিন্ম পাঁচ মিনিট তো প্রেজেন্ট করতেই হবে। সে হিসেবে ডকুমেন্ট আর সাইট ঘেঁটে অনেক তথ্য বের করে বানাতে লাগলাম। আমার পার্ট শেষ করে গ্রুপমেটদের অবস্থা দেখলাম। ভার্সিটির গ্রুপ ওয়ার্ক মানে পাঁচজনের একজন বা দুজন কাজ করা আর বাকীরা লাট সাহেবের মতো পায়ের উপর পা তুলে ঘুম প্র্যাকটিস করা। কিন্তু বিস্ময়করভাবে এই কোর্সের গ্রুপটায় মোটামুটি সবাই অ্যাকটিভ, তাই কাজ করতে ভালই লাগে। সবাই রাত একটার মধ্যে যার যার পার্টের কাজ পাঠিয়ে দিলো, আর আমি সবগুলো জোড়া লাগিয়ে পাওয়ার পয়েন্টে দাঁড় করাতে রাত প্রায় চারটা হয়ে গেল। পরদিন সকাল সাড়ে নয়টা প্রেজেন্টেশন! দুচোখের অভিমান ভাঙ্গাতে ঘুমুতে গেলাম সাড়ে পাঁচটায়!
৪.
রাতে বারোটার দিকে রিভা নক দিলো ফেসবুকে, 'দোস্ত, বাসায় আসলাম'। আগেরদিন রিভার আম্মু রাস্তার গর্তে পড়ে পা ভেঙ্গে গেছে। পঙ্গু হাসপাতালে রয়েছে। ঢাকা শহরে বিনা নোটিসে বৃষ্টির মাঝে যেমন অলি-গলি সব তলিয়ে যায় হুট করে ঠিক তেমনি মানুষের হাত-পা ভাঙ্গার কোন ঠিক ঠিকানা নেই আসলে। আমি নিজেই এক বছরের ব্যাবধানে পা-হাত ভেঙ্গেছিলাম দুবছর আগে। আহা, সে কি যন্ত্রণা! একটু পর রাশেদ নক দিয়ে বলে, 'ভাই নার্ভাস লাগছে। কাল প্রেজেন্টেশনে কি বলবো বুঝতেছিনা!' আমি হাসি, আরে মিয়া যা মুখে আসে বলে দিবা। বিদেশী ফ্যাকাল্টি মেম্বার, ভালো আছে মানুষটা!
রাশেদ ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট। পলিটিকাল সাইন্সে আমার গ্রুপমেট। হাসিখুশি মানুষ, অল্প কদিনেই বেশ ভাল সম্পর্ক হয়ে গেছে। দেখামাত্রই একটা হাসি বরাদ্দ আছে, আর বলে, 'মিয়া কোর্সে তো ফাঁটাবা.. আমি তো পলিটিক্স কম বুঝি.. কি যে হবে..' বলেই আবার হাসি! দেশের বাড়ী রাঙ্গামাটি আর পরিবারসহ থাকে উত্তরায়। আগেরদিনই ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় এলো। তো রাতে আবার প্রেজেন্টেশন স্লাইড রেডি করার শেষের দিকে আমিই নক দিলাম, ও বলে.. 'ভাই.. কি যে হবে কাল! প্রেজেন্টেশন যে কি দিবো' লিখেই দুজনের ইমোটিকন বিনিময়.. হাহা-হিহি!
৫.
দেড় ঘন্টার ছোটখাটো ঘুম দিয়ে সকালে বাসা থেকে বের হতে হতেই সাড়ে সাতটা বেজে গেলো। রাজলক্ষী পৌঁছাতেই রাশেদের ফোন। হ্যালো বলার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে রাশেদের গলাটা রাশভারী মনে হলো। ফুরফুরে মেজাজের কোন ছোঁয়াও নেই গলায়। বললো, তার বাবা খুব অসুস্থ, চিটাগাং-এ হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে.. অবস্থা সুবিধার না। চিটাগাং যাচ্ছে ও, ম্যাডামকে যেন জানাই ওর ব্যাপারটা। ও যখন বললো অবস্থা সুবিধার না তখন বুকের ভের ধক্ করে উঠলো। আমার ঠিক ছয় বছর আগের কথা মনে পড়লো। ২৬ মে, ২০০৯। আসলে ঘুরে ফিরে বোধহয় সবাইকে এমন দিন ফেইস করতে হয়, তবু দোয়া করছিলাম আমার মতো পরিণতি যাতে তার এখনই না দেখতে হয়।
৬.
প্রেজেন্টেশন বেশ ভালোই হলো, আর ম্যাডাম-ও খুশী হলো। প্রেজেন্টেশনের শেষে সার্ক অ্যানথিমটার ভিডিও প্লে করলাম, ম্যাডাম উপমহাদেশীয় নাচ-গান আর বিভিন্ন জায়গার উপর করা দেড় মিনিটের ভিডিওটা বেশ পছন্দ করলেন। ওদিন আর কোন ক্লাস না থাকায় বেশ ফুরফুরে মেজাজে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরছিলাম। বদ-অভ্যাসবসত বাসে বসেই মোবাইল গুতানো শুরু করলাম, ফেবু হোমপেইজে দেখি রাশেদকে ট্যাগ করে ওর কোন এক বন্ধু স্ট্যাটাস পোষ্ট করেছে। স্পষ্ট করে লেখা না থাকলেও যা বুঝলাম তার মানে দাঁড়াচ্ছে রাশেদের বাবা বোধহয় ওপারেই পাড়ি জমিয়েছেন। মানে আমর ২৬ মে-টা বোধহয় রাশেদের জন্য ২৮ জুলাই এলো। ঘুমিয়ে পড়লাম দুপুরে, রাতে ঘুম থেকে উঠে ওর টাইমলাইনে গিয়ে দেখলাম অনেকেই পোষ্ট করেছে। মানে যা ভাবছিলাম তা-ই! হাত পা ভাঙ্গা বোধহয় অনেক ভালো, তবে এমন হুটহাট মৃত্যুদূত এসে জলজ্যান্ত একটা মানুষকে ওপারে নিয়ে চলে যাওয়া সত্যিই বড় কষ্টের। পৃথিবীর একটা অদ্ভূত ব্যাপার হলো এক জায়গায় ভূমিকম্প হয়ে ভেঙ্গে-চুরে গেলেও বাকী পৃথিবীর কিছুই হয় না। ঠিক তেমনই কারো আপনজন চলে গেলে তার বুকের ভেতরের ভূমিকম্পটা বোধহয় পৃথিবীর অন্য মানুষরা টের পায় না। শুধু ধ্বংসাবশেষই দেখতে পায়। ভূমিকম্প এবার আমার ভেতরটায় হয়নি, তবে জানি রাশেদের ভেতরে ঠিক কতটা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে!
"কানাই তুমি খেইড় খেলাও ক্যানে?"
ভোর ৪টা ৪৪
৩১ জুলাই, ২০১৫
উত্তরা।
পৃথিবীর সবচে কষ্টের কাজগুলোর একটা হল এই সুদূর উত্তরা থেকে জ্যাম ঠেলে ঠেলে নীলক্ষেত যাওয়া, আবার আসা। আর এই কষ্টের কাজটা এড়াতে কিছু বাড়তি পয়সা গেলেও অনলাইনে বই অর্ডার করে কিনে নেই। কিন্তু ঈদের ছুটি থাকায় বই ডেলিভারী বন্ধ থাকায় বাধ্য হয়েই নীলক্ষেত গিয়ে কিছু বই কিনে নিয়ে এলাম গত শুক্রবার। ভাবছিলাম সোমবার থেকে মোটামুটি ফ্রি থাকবো, শুক্রবারের মধ্যেই কিছু পড়া হয়ে যাবে আর অবসরটাও ভালই কাটবে। কিন্তু যেমন ভাবনা তেমনভাবে কি দুনিয়া চলে? কিছুই হয়নি। 'ক্রাচের কর্নেল' শুরু করেও বেশীদূর যেতে পারিনি এখনো। তবে বেশ ভালো লাগছে বইটা, যদিও উপন্যাসটার মূল পরিণতি মানে কর্ণেল তাহেরে ফাঁসি হয়ে যাবে শেষে জানি তবুও বইটা পড়ে অনেক তথ্যই জানতে পারছি। ওহ্.. এটা উপন্যাস কি না এ নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। রিভিউ জানতে গিয়েই ফেসবুকে বইপোকা গ্রুপে তুমুল বিতর্ক দেখলাম। বইয়ের লেখক সাহাদুজ্জামান আদৌ কোন উপন্যাসিক কিনা এ নিয়ে কিংবা সে মূলত ছোটগল্পকার - এসব নিয়ে বিতর্ক দেখে বইটা পড়ার উৎসাহ অনেকাংশেই বেড়ে গিয়েছিলো। তবে বইটা পড়া আমার কাছে সরাসরি না দেখা কোন বিখ্যাত ফুটবল ম্যাচের রিটেলিকাস্ট দেখছি, যার ফলাফল আগের থেকেই জানি।
২.
গত কিছুদিন ধরেই হুটহাট অনেকের সাথে পরিচয় হচ্ছে। ব্যাপারটা অনেকদিন ধরে হচ্ছিলো না। ভার্সিটিতে ভর্তির পর টানা দেড়-দুই বছর অনেক অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে, অনেকের সাথে ভালো সম্পর্ক হয়েছে, অনেকের সাথে হাই-হ্যালো সম্পর্ক আর কারো কারো সাথে মনকষাকষিতে সম্পর্কই ভেঙ্গে গেছে - এমনটা সচরাচর হয় আরকি। রিভার সাথে পরিচয় কবে ঠিক মনে নেই, তবে আমাদের টিনএজের শেষের দিকে যখন মিগ৩৩ বা মিগ থার্টি থ্রি খুব জনপ্রিয় ছিলো মোবাইলে চ্যাটিং সফটওয়্যার হিসেবে তখন রঙ্গের মেলা নামে গ্রুপে। ফেসবুকেও ছিলো তখন থেকেই তবে লাইক-কমেন্টের বাইরে 'টুঁ' শব্দটাও চ্যাট হয়নি এমন আরকি। তো হঠাৎ করে কয়েকমাস আগে চ্যাট হলো, তাও খুব সম্ভবত শুক্রবার জুম্মার নামাজের টাইমে স্ট্যাটাস আপডেট করায় নামাজ পড়ি কিনা জিজ্ঞেস করেছিলো। তো যা হবার, কথায় কথায় এখন তুই তোকারি করে পচায় আরকি যে কিনা তিন-চার বছর ধরে আপনি-তুমির বাইরে সম্ভোধন করেনি। এ জন্যই বোধহয় জীবনের নাম 'গেবন' হয়ে গেছে!
৩.
কোন এক অদ্ভূত কারণে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যাপারে কিছু অবিশ্বাস্য মিথ চালু আছে। যেমন 'তারা কিছু পড়া লাগে না - এমনি এমনি ভাল গ্রেড পায়', 'টাকা দিয়ে পড়ে তাই এদের না পড়লেও রেজাল্ট ভালো হয়', 'এরা কিছু পারে না খামোখাই ভাব মারে', 'এরা ভার্সিটিতে গিয়ে আড্ডা মারে-এখানে ওখানে খেতে যায় আর সেলফি তোলে আপলোড মারে.. এরা কি ক্লাসে যায় নাকি কখনো? পড়ালেখা তো দূরের ব্যাপার।' ইত্যাদি ইত্যাদি। তো আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে কষে থাপ্পর মারি এমন কথা বলা কিছু মানুষকে। এরা দু-একজনের লাইফস্টাইল দেখে সহজ সমীকরণ দিয়ে বখাইট্টা যুক্তি দেখান যে 'অমুক এটা করে, অতএব অমুকের ভার্সিটির সবাই এটাই করে'! বিশেষ করে থাপরাইতে ইচ্ছে করে যখন অনেক কষ্টে খেঁটে মেটে প্রোজেক্ট, আসাইনমেন্ট, পরীক্ষা সব ঠিকভাবে দেয়ার পরও এ-এ মাইনাস ছুটে যায় তখন। ঈদের ছুটিতে এ টাইপের কথাবার্তা শুনে গতকিছুদিন ধরেই মিস্টার মেজাজ আর তার 'বরফ স্টেট' থেকে উওপ্ত উনুনে জ্বলছে। যাই হোক, পলিটিক্যাল সাইন্স কোর্সের ইনস্ট্রাক্টর এক আমেরিকান ভদ্রমহিলা (এবং পলিটিশিয়ান)। সত্যি বলতে এ কোর্সের মতো মজার কোর্স আমি আমার ইহজগতে কম করছি। মঙ্গলবার ছিলো গ্রুপ প্রেজেন্টেশন। প্রেজেন্টেশন টপিক ছিলো সার্ক। আর আমাদের গ্রুপ রবিবার পর্যন্ত কোন কাজই করিনি। আমাদের গ্রুপের নাম 'মিশন ইম্পসিবল'। তো সোমবার মিড দিয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বিকেলে উঠে শুরু করলাম কাজ, ইম্পসিবল মিশনকে পসিবল করে পরের দিনের জন্য প্রেজেন্টেশন স্লাইড রেডী করা। ত্রিশ মিনিটের প্রেজেন্টশন, অতএব পাঁচজনকে সর্বনিন্ম পাঁচ মিনিট তো প্রেজেন্ট করতেই হবে। সে হিসেবে ডকুমেন্ট আর সাইট ঘেঁটে অনেক তথ্য বের করে বানাতে লাগলাম। আমার পার্ট শেষ করে গ্রুপমেটদের অবস্থা দেখলাম। ভার্সিটির গ্রুপ ওয়ার্ক মানে পাঁচজনের একজন বা দুজন কাজ করা আর বাকীরা লাট সাহেবের মতো পায়ের উপর পা তুলে ঘুম প্র্যাকটিস করা। কিন্তু বিস্ময়করভাবে এই কোর্সের গ্রুপটায় মোটামুটি সবাই অ্যাকটিভ, তাই কাজ করতে ভালই লাগে। সবাই রাত একটার মধ্যে যার যার পার্টের কাজ পাঠিয়ে দিলো, আর আমি সবগুলো জোড়া লাগিয়ে পাওয়ার পয়েন্টে দাঁড় করাতে রাত প্রায় চারটা হয়ে গেল। পরদিন সকাল সাড়ে নয়টা প্রেজেন্টেশন! দুচোখের অভিমান ভাঙ্গাতে ঘুমুতে গেলাম সাড়ে পাঁচটায়!
৪.
রাতে বারোটার দিকে রিভা নক দিলো ফেসবুকে, 'দোস্ত, বাসায় আসলাম'। আগেরদিন রিভার আম্মু রাস্তার গর্তে পড়ে পা ভেঙ্গে গেছে। পঙ্গু হাসপাতালে রয়েছে। ঢাকা শহরে বিনা নোটিসে বৃষ্টির মাঝে যেমন অলি-গলি সব তলিয়ে যায় হুট করে ঠিক তেমনি মানুষের হাত-পা ভাঙ্গার কোন ঠিক ঠিকানা নেই আসলে। আমি নিজেই এক বছরের ব্যাবধানে পা-হাত ভেঙ্গেছিলাম দুবছর আগে। আহা, সে কি যন্ত্রণা! একটু পর রাশেদ নক দিয়ে বলে, 'ভাই নার্ভাস লাগছে। কাল প্রেজেন্টেশনে কি বলবো বুঝতেছিনা!' আমি হাসি, আরে মিয়া যা মুখে আসে বলে দিবা। বিদেশী ফ্যাকাল্টি মেম্বার, ভালো আছে মানুষটা!
রাশেদ ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট। পলিটিকাল সাইন্সে আমার গ্রুপমেট। হাসিখুশি মানুষ, অল্প কদিনেই বেশ ভাল সম্পর্ক হয়ে গেছে। দেখামাত্রই একটা হাসি বরাদ্দ আছে, আর বলে, 'মিয়া কোর্সে তো ফাঁটাবা.. আমি তো পলিটিক্স কম বুঝি.. কি যে হবে..' বলেই আবার হাসি! দেশের বাড়ী রাঙ্গামাটি আর পরিবারসহ থাকে উত্তরায়। আগেরদিনই ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় এলো। তো রাতে আবার প্রেজেন্টেশন স্লাইড রেডি করার শেষের দিকে আমিই নক দিলাম, ও বলে.. 'ভাই.. কি যে হবে কাল! প্রেজেন্টেশন যে কি দিবো' লিখেই দুজনের ইমোটিকন বিনিময়.. হাহা-হিহি!
৫.
দেড় ঘন্টার ছোটখাটো ঘুম দিয়ে সকালে বাসা থেকে বের হতে হতেই সাড়ে সাতটা বেজে গেলো। রাজলক্ষী পৌঁছাতেই রাশেদের ফোন। হ্যালো বলার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে রাশেদের গলাটা রাশভারী মনে হলো। ফুরফুরে মেজাজের কোন ছোঁয়াও নেই গলায়। বললো, তার বাবা খুব অসুস্থ, চিটাগাং-এ হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে.. অবস্থা সুবিধার না। চিটাগাং যাচ্ছে ও, ম্যাডামকে যেন জানাই ওর ব্যাপারটা। ও যখন বললো অবস্থা সুবিধার না তখন বুকের ভের ধক্ করে উঠলো। আমার ঠিক ছয় বছর আগের কথা মনে পড়লো। ২৬ মে, ২০০৯। আসলে ঘুরে ফিরে বোধহয় সবাইকে এমন দিন ফেইস করতে হয়, তবু দোয়া করছিলাম আমার মতো পরিণতি যাতে তার এখনই না দেখতে হয়।
৬.
প্রেজেন্টেশন বেশ ভালোই হলো, আর ম্যাডাম-ও খুশী হলো। প্রেজেন্টেশনের শেষে সার্ক অ্যানথিমটার ভিডিও প্লে করলাম, ম্যাডাম উপমহাদেশীয় নাচ-গান আর বিভিন্ন জায়গার উপর করা দেড় মিনিটের ভিডিওটা বেশ পছন্দ করলেন। ওদিন আর কোন ক্লাস না থাকায় বেশ ফুরফুরে মেজাজে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরছিলাম। বদ-অভ্যাসবসত বাসে বসেই মোবাইল গুতানো শুরু করলাম, ফেবু হোমপেইজে দেখি রাশেদকে ট্যাগ করে ওর কোন এক বন্ধু স্ট্যাটাস পোষ্ট করেছে। স্পষ্ট করে লেখা না থাকলেও যা বুঝলাম তার মানে দাঁড়াচ্ছে রাশেদের বাবা বোধহয় ওপারেই পাড়ি জমিয়েছেন। মানে আমর ২৬ মে-টা বোধহয় রাশেদের জন্য ২৮ জুলাই এলো। ঘুমিয়ে পড়লাম দুপুরে, রাতে ঘুম থেকে উঠে ওর টাইমলাইনে গিয়ে দেখলাম অনেকেই পোষ্ট করেছে। মানে যা ভাবছিলাম তা-ই! হাত পা ভাঙ্গা বোধহয় অনেক ভালো, তবে এমন হুটহাট মৃত্যুদূত এসে জলজ্যান্ত একটা মানুষকে ওপারে নিয়ে চলে যাওয়া সত্যিই বড় কষ্টের। পৃথিবীর একটা অদ্ভূত ব্যাপার হলো এক জায়গায় ভূমিকম্প হয়ে ভেঙ্গে-চুরে গেলেও বাকী পৃথিবীর কিছুই হয় না। ঠিক তেমনই কারো আপনজন চলে গেলে তার বুকের ভেতরের ভূমিকম্পটা বোধহয় পৃথিবীর অন্য মানুষরা টের পায় না। শুধু ধ্বংসাবশেষই দেখতে পায়। ভূমিকম্প এবার আমার ভেতরটায় হয়নি, তবে জানি রাশেদের ভেতরে ঠিক কতটা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে!
"কানাই তুমি খেইড় খেলাও ক্যানে?"
ভোর ৪টা ৪৪
৩১ জুলাই, ২০১৫
উত্তরা।